নামাজের গুরুত্ব:
আল্লাহ মানুষকে তার এবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষ নয় ; মানুষ ও জ্বীন-উভয় জাতিকে আল্লাহ তার এবাদত তথা তার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (الذاريات :56)
অর্থাৎ আমি মানব ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
ফলে তিনি মানুষের জন্য কিছু দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক এবাদতের প্রচলন করেছেন।
দৈহিক এবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান এবাদত হল সালাত। সালাত এমন একটি এবাদত যাকে আল্লাহ তার মাঝে এবং তার বান্দার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন।
সালাতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সাথে দেয়া প্রতিশ্রুতির বার বার প্রতিফলন ঘটায়। সে তার প্রভু বা স্রষ্টাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সে তার প্রতিশ্রুতি পালন করে যাচ্ছে। এ সালাতের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কংটকমুক্ত হয়। সালাত ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরিয়ে আনে। গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। সালাতের মাধ্যমে ছগীরা তথা ছোট ছোট গুনাহগুলো হতে পরিত্রাণ লাভ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
তোমরা সমস্ত নামাজের প্রতি যত্মবান হবে, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজকে (জোহরের নামাজকে) সযত্নে রক্ষা করবে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে।” (সূরা বাকারাহ:২৩৮)
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
যদি তোমরা শত্রু বা বিপদের আশঙ্কা কর তখন তোমরা পদচারী বা আরোহী অবস্থাতেই নামাজ পড়বে। যদি তোমরা নিরাপদ বোধ কর, তবে আল্লাহকে স্মরণ করবে যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।” (সূরা বাকারাহ:২৩৯)
মানুষের শারীরিক সুস্থতার জন্য উপযুক্ত ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ জরুরী। যদি কেউ পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে দুর্বল বা অসুস্থ হয়ে পড়বে। তেমনি আমাদের আত্মার উন্নতি ও পূর্ণতার জন্য স্রষ্টা অর্থাৎ মহান আল্লাহর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার। আর এজন্যেই আহার গ্রহণের মত নামাজও দিনে কয়েকবার আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমাদের শরীর ও আত্মা সমানতালে পূর্ণতা লাভ করে এবং আমাদের আত্মা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হয়ে সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তাই এই আয়াতে নামাজের বিষয়ে সচেতন থাকার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়ও এই ফরজ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের সময় নামাজকে স্বাভাবিক অবস্থার মত আদায় করা সম্ভব নয় বলে ইসলাম বিকল্প পন্থাও দেখিয়ে দিয়েছে। এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তা হলো: নামাজ সব সময়ই মানুষের জন্য দরকার। এমনকি যুদ্ধের সময়ও তা বাদ দেয়া যাবে না। নামাজের কারণে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিরক্ষার কাজে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় না। বরং নামাজ মুজাহিদদেরকে শারীরিক ও মানসিক মনোবল যোগায়।
কুরআনে নামাজের গুরুত্ব:
আমরা যদি এ আলোকগ্রন্থ তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করি, তাহলে পরিষ্কার দেখতে পাব, ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামায। আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালামে বিভিন্নভাবে নামাযের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিচিত্ররূপে নামাযের প্রতি আহ্বান করেছেন। এখানে আমরা কিছু দিক সম্পর্কে আলোচনা করব।
কোনো বিষয়ে গুরুত্বারোপের একটি সহজ-সরল পদ্ধতি হল সে বিষয়টির আদেশ করা। নামাযের উপর গুরুত্বারোপের জন্য এ পদ্ধতিটি কুরআনে অনেক ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআনে নামাযের সুস্পষ্ট আদেশ করা হয়েছে এবং বারবার বিভিন্নভাবে করা হয়েছে।
যেমন আল্লাহ বলেন-
وَاَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِیْنَ
এবং তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ কর।-সূরা বাকারা (২) : ৪৩
আয়াতের ব্যাখ্যা (তাফসীর):এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তিনটি মৌলিক ইবাদতের প্রতি আহ্বান করেছেন:
নামায কায়েম করা (أَقِيمُوا الصَّلَاةَ): এখানে ‘নামায কায়েম করা’ বলতে শুধু নামায পড়াই বোঝানো হয়নি, বরং তা যথাযথভাবে, নিয়ম-নীতি মেনে, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আদায় করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটি ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ।
যাকাত আদায় করা (آتُوا الزَّكَاةَ): যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ গরীবদের মাঝে বিতরণ করা, যা ইসলামে একটি ফরজ ইবাদত। এটা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনে এবং দরিদ্রদের সহায়তা করে।
রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ করা (وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ): এই অংশে আল্লাহ তাআলা একটি সামাজিক ও সম্মিলিত ইবাদতের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। নামায শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং মুসলিমদের জামাআতে, অর্থাৎ সমাজের অন্যান্য মুসল্লীদের সঙ্গে মিলে আদায় করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এতে মুসলিমদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও শৃঙ্খলা প্রতিফলিত হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّہَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ
আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো । আর নিশ্চয় তা বিনয়ীরা ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন। (সূরা বাকারা, আয়াত : ৪৫)
(১) ধৈর্য এবং নামায প্রত্যেক আল্লাহভীরু লোকের বড় হাতিয়ার। নামাযের মাধ্যমে একজন মু’মিনের সম্পর্ক মহান আল্লাহর সাথে বলিষ্ঠ হয়। এরই দ্বারা সে আল্লাহর নিকট থেকে শক্তি ও সাহায্য লাভ করে। ধৈর্যের মাধ্যমে কার্যে সুদৃঢ় এবং দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। হাদীসে এসেছে, “নবী কারীম (সাঃ)-এর সামনে যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসে উপস্থিত হত, তখন তিনি সত্বর নামাযের শরণাপন্ন হতেন।” (আহমদ, আবূ দাউদ, ফাতহুল ক্বাদীর)
(২) নামাযের যত্ন নেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য ভারী কাজ, কিন্তু বিনয়ী-নম্র মানুষের জন্য তা সহজ এবং নামায তাঁদের হূদয়ের প্রশান্তির উপকরণ। এই লোক কারা? এরা সেই লোক যাঁরা কিয়ামতের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ, কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস সৎকর্মসমূহকে সহজতর করে দেয় এবং আখেরাত থেকে উদাসীনতা মানুষকে আমলহীন; বরং বদ আমলের অভ্যাসী বানিয়ে দেয়।
হাদিসে নামাজের গুরুত্ব:
কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে; এ থেকেও নামাজের গুরুত্বের বিষয়টি বুঝে আসে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার কাজগুলোর মধ্যে নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। যদি সঠিকভাবে নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে, তবে সে নাজাত পাবে এবং সফলকাম হবে। যদি নামাজ নষ্ট হয়ে থাকে, তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিরমিযি, হাদীস: ৪১৩;
সাহল ইবনু উসমান আল আসকারী (রহঃ) ….. ইবনু উমার (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ পাঁচটি জিনিসের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। আল্লাহর ইবাদাত করা এবং তাকে ছাড়া আর সব কিছু অস্বীকার করা (অর্থাৎ ইবাদাতের মালিক তিনি একাই), সালাত কায়িম করা, যাকাত আদায় করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ করা ও রমাযানের সওম পালন করা। সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর: ১৬
মুহাম্মাদ ইবন ঈসা (রহঃ) …. হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাযে মশগুল হয়ে যেতেন। আবু দাউদ, হাদীস: ১৩১৯
যে-কোন বিপদাপদে ও সমস্যায় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা তাজা করে নেয়ার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করা যেতে পারে। সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও সত্যনিষ্ঠ ইমামদের থেকে এ ব্যাপারে বহু ঘটনা বর্ণিত আছে।
আলী ইবনে নসর ইবনে আলী আল–জাহযামী (রাহঃ)–হুরায়স ইবনে কাবীসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ আমি একবার মদীনায় এলাম। দুআ করলামঃ হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য একজন নেক সঙ্গী লাভ সহজ করে দাও। পরে আমি আবু হুরায়রা (রাযিঃ)–এর নিকটে গিয়ে বসলাম। বললামঃ একজন নেক সঙ্গী জুটিয়ে দিতে আমি আল্লাহর নিকট দুআ করেছিলাম। মেহেরবাণী করে আপনি রাসূল (ﷺ) থেকে যে হাদীস শুনেছেন তা আমাকে শুনান। হয়ত আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে আমাকে উপকৃত করবেন। তিনি বললেনঃ আমি রাসূল (ﷺ)–কে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মধ্যে সর্ব প্রথম হিসাব নেয়া হবে নামাযের। যদি তা সঠিক বলে গণ্য হয়, তবে সে হবে কল্যাণপ্রাপ্ত ও সফলকাম। আর যদি তা সঠিক বলে গণ্য না হয়, তবে সে হবে অসফল ও ক্ষতিগ্রস্ত।
নামাজ পরিত্যাগের বিধান:
নামাজ ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর ফরজ করা হয়েছে। নামাজ পরিত্যাগ করা একটি গুরুতর অপরাধ এবং এর জন্য কুরআন ও সুন্নাহতে কঠোর শাস্তির বর্ণনা রয়েছে। নিচে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নামাজ পরিত্যাগকারীর বিধান আলোচনা
কালেমার সাক্ষ্য দেওয়ার পর সালাতই ইসলামের অধিকতর গুরুত্ব ও তাগিদপূর্ণ রুকন বা স্তম্ভ এবং ইসলামের সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিকতা, প্রতীক ও উত্তম ইবাদত। এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা সালাতকে ঈমান নামে অভিহিত করেছেন। যেমন তাঁর বাণী:
﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡ﴾ [البقرة: ١٤٣]
“আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমান (সালাত)-কে নষ্ট করে দিবেন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৪৩]
বিগত শরী‘আতসমূহের মধ্য থেকেও কোনো শরী‘আত সালাতবিহীন ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي﴾ [ابراهيم: ٤٠]
“হে আমার রব! আমাকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্যে থেকেও।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০]
এবং ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا﴾ [مريم: ٣١]
“এবং তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৩১]
এবং ইসমাঈল আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِوَٱلزَّكَوٰةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِۦ مَرۡضِيّٗا ٥٥ ﴾ [مريم: ٥٥]
“সে তার পরিজনবর্গকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার রবের সন্তোষভাজন।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৫]
যাবতীয় ফরয বিষয় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মারফত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ফরয হয়েছে, কিন্তু সালাতের জন্য তাঁকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে কথপোকথন করেন এবং তাঁর প্রতি (পঞ্চাশ) ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেন। অতঃপর তা থেকে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত বাকী রাখা হয় যার নেকী ৫০ ওয়াক্তেরই সমান। আল্লাহরই সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ।
সালাত ইসলাম এবং কুফুরীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«بين الرجل وبين الشرك أو الكفر ترك الصلاة»
ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া আত তামীমী এবং উসমান ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ) … জাবির (রাযিঃ) বলেন যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত ছেড়ে দেয়া। (সহীহ মুসলিম)১৪৮.
তিনি আরো বলেন,
العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر
বুরাইদাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের ও তাদের (কাফিরদের) মধ্যে (মুক্তির) যে প্রতিশ্রুতি আছে তা হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দেয়, সে কুফুরী কাজ করে। জামি‘ আত-তিরমিযী হাদীস ২৬২১
প্রখ্যাত তাবেঈ শাকীক ইবন আব্দুল্লাহ আল-উকাইলী বলেন, “সাহাবায়ে কিরাম সালাত ব্যতীত অন্য কোনো আমল ছেড়ে দেওয়াকে কুফুরী মনে করতেন না।”
(সুনান তিরমিযী)হাদীস নম্বর: ২৬২২
উল্লিখিত ও অন্যান্য দলীলসমূহ সালাত পরিত্যাগকারী বড় কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ; যদিও সে পরিত্যাগকারী ব্যক্তি সালাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার না করে।
মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে আমরা এমন অনেকেই আছি যারা শুধু মনে করি নামায পড়া ভালো কাজ। কিন্তু আমরা জানি না ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নামাযের গুরুত্ব ও মর্যাদা কতটুকু? এটাও জানি না যে, নামায পরিত্যাগের মধ্যে একজন বনী আদমের জন্য কত ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আবার কেউ কেউ শুধু এতটুকু জানি যে, বে-নামাযীর গুনাহটা হবে শুধু পরকালে। অতএব, অন্তত: এখনতো ভালোই আছি। কেউ আবার ভাবি, বয়সতো তেমন হয়নি।সময় হোক…। অর্থাৎ নামায যেন বুড়াকালের আমল। অনেকেই নিজেকে সালাত আদায়কারী ভাবে শুধু শুক্রবার জুম’আ সালাত আদায় করেই। আবার যখন মনে চায় তখন সালাত আদায় করে এবং ইচ্ছে না করলে পড়ে না,এরাও মনে করে নিজেকে সালাত আদায়কারী।
আবার কেউ কেউ বলি, নামায শুরু করবো। তবে কাল থেকে…। শয়তানের প্ররোচনায় সময় হারিয়ে এভাবে যারা দিন পার করে দিচ্ছে তারা আগামীকালের খোঁজ আর পায় না। বরফের মতো সময় তাদের গলে যাচ্ছে। এমনই অবস্থায় হঠাৎ করে মৃত্যু এসে একদিন তাকে ঘেরাও করে ফেলে। অতঃপর তার পরিণতি কী হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত কত করুণ, এ বিষয়ে এখানে ক্ষুদ্র আলোচনা। শুরুতেই আল্লাহ তাআলার বাণী, এরপর রাসূলুল্লাহ (স)-এর কথা এবং সর্বশেষে উলামায়ে কিয়ামের ফাতাওয়া:
১. আল কুরআনে বলা হয়েছে,
“অতঃপর এমন এক সময় আসল যখন লোকেরা নামায ছেড়ে দিল, আর লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে গেল।ফলে তারা শীঘ্রই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়ে যাবে। তবে কিছু লোক এ থেকে রেহাই পাবে, যারা তাওবা করবে, ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে।” (সূরা ১৯; মারইয়াম ৫৯-৬০)।
২. আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে,
“(পরকালে জান্নাতবাসীরা ঠাট্টার ভাষায় দোযখবাসীদের জিজ্ঞেস করবে) কী অপরাধ তোমাদেরকে আজ আগুনে ঢুকিয়েছে? উত্তরে তারা বলবে-আমরা নামায পড়তাম না, আর মিসকীনকে খাবার দিতাম না।” (সূরা ৭৪; মুদ্দাসছির ৪২-৪৪)
৩. আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
“তারা ঈমান আনেনি, নামাযও পড়েনি। বরং উল্টো তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং (ঈমান থেকে) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।অহংকারের সাথে বাড়ি ফিরে গিয়েছে, পরিবারপরিজনের কাছে।(অতএব, হে বেঈমান, হে বে-নামাযী!) তোমার জন্য দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ!
আবারও বলছি, তোমার জন্য দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ! মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, কোন প্রকার হিসাব-নিকাশ ছাড়া) এমনিই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা ৭৫; কিয়ামাহ ৩১-৩৬)
৪. আল্লাহ তাআলা বলেন,
“(কিয়ামতের) দিন হাঁটুর নিম্নাংশ উন্মুক্ত করা হবে, আর (বেনামাযীদেরকে ডাকা হবে তাদের রবকে সিজদা করার জন্য। কিন্তু সেদিন তারা তা (শত চেষ্টা করলেও) পারবে না। তাদের দৃষ্টি থাকবে ভীত বিহ্বল এবং অবস্থা হবে অত্যন্ত অপমানজনক। (দুনিয়ার জীবনে যখন) তাদেরকে (নামাযের) সিজদার জন্য ডাকা হতো (তখন তা তারা করেনি)। অথচ তারা তখন ছিল সুস্থ (ও সক্ষম)। (সূরা ৬৮; কলম ৪২-৪৩) উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ে ইমাম বুখারী (র) একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তা হলো, আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেন, আমাদের রব তাঁর পায়ের গোছা উন্মুক্ত করবেন। তখন প্রত্যেক মুমিন নর-নারী তাকে সিজদা করবে।(কিন্তু বেনামাযীরা সেদিন তা পারবে না।)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন তাদের বলা হতো রুকু কর (অর্থাৎ নামায পড়) তখন তারা রুকু করত না (অর্থাৎ নামায পড়তো না) সত্যকে যারা মিথ্যা বলতো ঐসব লোকদের জন্য ধ্বংস।” (সূরা ৭৭; মুরসালাত ৪৮)। যারা এ যিকির (সালাত আদায় করবে না তাদের জীবন হবে সংকুচিত (কঠিন) এবং কিয়ামতের দিন হাশরে উঠবে তারা অন্ধ অবস্থায়।
“(হ্যা,) যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তার জন্যে (জীবনে) বাঁচার সামগ্রী সংকুচিত হয়ে যাবে, (সর্বোপরি) তাকে আমি কিয়ামতের দিন অন্ধ বানিয়ে হাজির করবো।” (সূরা ২০; ত্বা-হা ১২৪)
নামাজ পরিত্যাগকারীর পরকালীন বিধান:
বেনামাযীকে কবরে শাস্তি দেওয়া হবে, যেমন সহীহ বুখারীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্বপ্নের বর্ণনায় রয়েছে: “তিনি চিৎ অবস্থায় শায়িত এক ব্যক্তির নিকট আসলেন, এমতাবস্থায় একটি পাথর হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্য একজন, অতঃপর সে উক্ত পাথর দিয়ে তার (শায়িত ব্যক্তির) মাথায় আঘাত করছে, যার ফলে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, পাথরটি ছিটকে দূরে চলে যাচ্ছে, পুনরায় সে দৌড়ে গিয়ে পাথরটি নিয়ে ফিরা মাত্র উক্ত ব্যক্তির মাথা পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় ঐ ব্যক্তি আপন স্থানে ফিরে তাকে ঐ ভাবেই (শাস্তি) দিচ্ছে যেভাবে প্রথমবার দিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন তখন দুই ফিরিশতা তাঁকে অবহিত করেন যে, এতো ঐ ব্যক্তি যে কুরআন পড়ত, কিন্তু তার প্রতি আমল করত না এবং ফরয সালাত ছেড়ে ঘুমাত।সহীহ বুখারী
হাদিস নম্বর: ৭০৪৭
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٣]
“তোমাদেরকে কিসে সাকার (জাহান্নাম)-এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৪২-৪৩]
কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَخَلَفَ مِنۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُوا۟ ٱلشَّهَوَٰتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
তাদের পর এমন একদল উত্তরসূরি এল যারা সালাত ত্যাগ করল এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করল। তারা অচিরেই গোমরাহিতে পতিত হবে।”
—সূরা মারইয়াম (১৯:৫৯)
আলী ইবনে নসর ইবনে আলী আল–জাহযামী (রাহঃ)–হুরায়স ইবনে কাবীসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ আমি একবার মদীনায় এলাম। দুআ করলামঃ হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য একজন নেক সঙ্গী লাভ সহজ করে দাও। পরে আমি আবু হুরায়রা (রাযিঃ)–এর নিকটে গিয়ে বসলাম। বললামঃ একজন নেক সঙ্গী জুটিয়ে দিতে আমি আল্লাহর নিকট দুআ করেছিলাম। মেহেরবাণী করে আপনি রাসূল (ﷺ) থেকে যে হাদীস শুনেছেন তা আমাকে শুনান। হয়ত আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে আমাকে উপকৃত করবেন। তিনি বললেনঃ আমি রাসূল (ﷺ)–কে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মধ্যে সর্ব প্রথম হিসাব নেয়া হবে নামাযের। যদি তা সঠিক বলে গণ্য হয়, তবে সে হবে কল্যাণপ্রাপ্ত ও সফলকাম। আর যদি তা সঠিক বলে গণ্য না হয়, তবে সে হবে অসফল ও ক্ষতিগ্রস্ত।
নামাজের ইহকালীন ও পরকালীন উপকারিতা ফযীলত:
মুহাম্মাদ ইবনু হারব .. আবদুল্লাহ্ ইবনুুস-সুনাবিহী (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ মুহাম্মাদের মতানুযায়ী বেতেরের নামায ওয়াজিব (ফরয)। উবাদা ইবনুস-সামিত (রাঃ) বলেন, আবূ মুহাম্মাদের ধারণা সঠিক নয়। আমি এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি উত্তমরূপে উযূ (ওজু/অজু/অযু) করে নির্ধাবিত সময়ে বিনয়ের সাথে নামায আদায় করবে-তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, আল্লাহ্ তার সমস্ত পাপ মাফ করবেন। অপরপক্ষে যারা এরূপ করবে না তাদের জন্য আল্লাহর কোন অঙ্গীকার নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাদের ক্ষমা করবেন অন্যথায় শাস্তি দেবেন। সুনান আবু দাউদ: ৪২৫,
সালাত বান্দা ও তার প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِب
কখনই নয়, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। আপনি সেজদা করুন ও আমার নৈকট্য অর্জন করুন।
[সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১৯]
অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং সমস্ত সৎ কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর, আর সৎ কাজের মধ্যে আল্লাহর জন্য সাজদাহ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “বান্দা স্বীয় রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সাজদাহ অবস্থায়। অতএব, তোমরা সাজদায় বেশি-বেশি দো‘আ কর। সুনান নাসাঈ: হাদীস ১১৩৭,
আবূ আমর শায়বানি (রহঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস’উদ (রাঃ)-এর বাড়ির দিকে ইংগিত করে বলেন, এ বাড়ির মালিক আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহ্র নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ‘যথা সময়ে সালাত আদায় করা। ইবনু মাস’উদ (রাঃ) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, অতঃপর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ (আল্লাহ্র পথে জিহাদ)।
সালাতের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন আত্মিক প্রশান্তি-আরাম এবং চক্ষু শীতলতা: আল্লাহ বলেন,
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِكۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِكۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ
রাই ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই দিলের সত্যিকারের প্রশান্তি লাভ করা যায়। সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮
আল্লাহ তা‘আলা বলেন.
,إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর।
সালিম ইবনু আবুল জা’দ (রহঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলেন, মিস‘আর বলেছেন, আমার ধারণা, সে ব্যক্তি খুযাআ গোত্রীয়, যদি আমি সলাত পড়তাম তাহলে প্রশান্তি পেতাম। উপস্থিত লোকজন নারাজ হলো। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ হে বিলাল। সলাত ক্বায়িম করো। আমরা এর মাধ্যমে স্বস্তি লাভ করতে পারবো। সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৮৫
সালাতই হলো বান্দা এবং তার রবের মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যম, যেমন ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। অতএব মুসলিম যখন কোনো কাজের মনস্থ করবে সে মহিমান্বিত আল্লাহর স্মরণাপন্ন হবে যাঁর হাতে রয়েছে সব কিছুর ক্ষমতা, যিনি কোনো ব্যাপারে বলেন হয়ে যাও, আর তা হয়ে যায়, যিনি আর্ত অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন। আল্লাহ তা‘আালা বলেন,
اَمَّنۡ يُّجِيۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَيَجۡعَلُكُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَاِلٰـهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ قَلِيۡلًا مَّا تَذَكَّرُوۡنَ ؕ
বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে ? তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।
সালাত ইহকাল ও পরকালে মুমিনদের জন্য দৃঢ়তা ও স্থিরতা আনে: অতএব, সালাত আদায়কারীর যখন সুখ আসে তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আর তা তার জন্য উত্তম এবং যখন কোনো বিপদ দেখা দেয় তখন ধৈর্য ধারণ করে, সেটাও তার জন্য কল্যাণকর।
জামা‘আতে সালাত আদায়ের বিধান কী?
সালাত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন যার মাহাত্ম্য কুরআন ও হাদীসে বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে সালাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বার বার তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি প্রতি বেলা সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার ব্যাপারেও পূর্ণ যত্নবান হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
حَٰفِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وَٱلصَّلَوٰةِ ٱلۡوُسۡطَىٰ وَقُومُواْ لِلَّهِ قَٰنِتِينَ
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও বিশেষ করে আসরের সালাতের প্রতি এবং তোমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহ তা‘আলার জন্য দণ্ডায়মান হও”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৮.
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সালাতের প্রতি যত্নবান হতে আদেশ করেছেন। আর যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করে না সে সালাতের প্রতি কতটুকু যত্নবান তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
তেমনিভাবে তিনি সালাত আদায়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনকে মুনাফিকী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
﴿إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمۡ وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٤٢ مُّذَبۡذَبِينَ بَيۡنَ ذَٰلِكَ لَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ وَلَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِۚ وَمَن يُضۡلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلٗا ١٤٣﴾ “মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোকা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা উহার প্রতিদান দিবেন। তারা অলস মনে সালাত আদায় করতে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে। তারা সর্বদা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত থাকে। না এদিক না ওদিক। যাকে আল্লাহ তা‘আলা পথভ্রষ্ট করেন আপনি কখনো তাকে সুপথ দেখাতে পারেন না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২-১৪৩
দৈনিক পাঁচ বেলা সালাত জামা‘আতে পড়া প্রতিটি সক্ষম ও সাবালক পুরুষের ওপরই ওয়াজিব।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ
তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। অর্থাৎ সালাত আদায়কারীদের সাথে সালাত আদায় করো”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩]
উক্ত আয়াত জামা‘আতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট। কারণ, আয়াতের শেষাংশ থেকে সালাত প্রতিষ্ঠাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তা আয়াতের প্রথমাংশের সাথে প্রকাশ্য সামঞ্জস্যহীনই মনে হয়। কেননা, আয়াতের প্রথমাংশে সালাত প্রতিষ্ঠার আদেশ রয়েছে। তাই আয়াতের শেষাংশে তা পুনরুল্লেখের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। তাই বলতে হবে, আয়াতের শেষাংশে জামা‘আতে সালাত আদায়েরই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: যখন আপনি তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করতে যান তখন তাদের এক দল যেন অস্ত্রসহ আপনার সাথে সালাত আদায় করতে দাঁড়ায়। অতঃপর তারা সাজদাহ সম্পন্ন করে যেন আপনার পেছনে চলে আসে। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় দলটি যারা পূর্বে সালাত পড়ে নি আপনার সাথে যেন সালাত পড়ে নেয়। তবে তারা যেন সতর্কতা ও অস্ত্রধারণাবস্থায় থাকে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০২]
উক্ত আয়াতে যুদ্ধাবস্থায় জামা‘আতে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে। যদি পরিবেশ শান্ত থাকাবস্থায় জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে কোনো ছাড় থাকতো তথা তা সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাব হতো তা হলে যুদ্ধাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণকে জামা‘আতে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শেখানোর কোনো প্রয়োজনই অনুভূত হতো না। বরং তারা উক্ত ছাড় পাওয়ার বেশি উপযুক্ত ছিলো। যখন তা হয় নি তখন আমাদেরকে বুঝতেই হবে, জামা‘আতে সালাত আদায় করা নিহায়েত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। তাই ওযর ছাড়া কারোর জন্য ঘরে সালাত পড়া জায়িয নয়।
তেমনিভাবে উক্ত আয়াতে উভয় দলকেই জামা‘আতে সালাত আদায় করতে আদেশ করা হয়েছে। যদি কেউ কেউ জামা‘আতে সালাত পড়লে অন্যদের পক্ষ থেকে উক্ত দায়িত্ব আদায় হয়ে যেতো তাহলে উভয় দলকেই এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে জামা‘আতে সালাত আদায় করতে আদেশ করা হতো না। তাই জামা‘আতে সালাত পড়া প্রতিটি ব্যক্তির ওপরই ওয়াজিব। চাই সে সফরে থাকুক অথবা নিজ এলাকায়।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
وۡمَ يُكۡشَفُ عَن سَاقٖ وَيُدۡعَوۡنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ فَلَا يَسۡتَطِيعُونَ ٤٢ خَٰشِعَةً أَبۡصَٰرُهُمۡ تَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ وَقَدۡ كَانُواْ يُدۡعَوۡنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ وَهُمۡ سَٰلِمُونَ
“স্মরণ করো সে দিনের কথা যে দিন জঙ্ঘা (হাঁটুর নিম্নাংশ) উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে আহ্বান করা হবে সাজদাহ করার জন্য তখন তারা তা করতে সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি থাকবে তখন অবনত এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিলো তখন তাদেরকে সাজদাহ করার জন্য আহ্বান করা হয়েছিলো। (কিন্তু তারা তখন সে আহ্বানে সাড়া দেয় নি)”। [সূরা আল-ক্বালাম, আয়াত: ৪২-৪৩]
আল্লামা ইবরাহীম তাইমী রহ. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন: তাদেরকে আযান ও ইক্বামতের মাধ্যমে ফরয সালাতগুলো জামা‘আতে আদায়ের জন্য ডাকা হতো।
বিশিষ্ট তাবঈ আল্লামা সা‘য়ীদ ইবন মুসাইয়িব রহ. বলেন: তারা “হাইয়া ‘আলাস-সালাহ, হাইয়া ‘আলাল-ফালাহ” শুনতো অথচ তারা সুস্থ থাকা সত্ত্বেও মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করতো না।
কা‘ব আল-আহবার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর কসম! উক্ত আয়াতটি জামা‘আতে সালাত না পড়া লোকদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে।
ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি তো অন্ধ, আমার ঘরও দূরে অবস্থিত। আমার একজন পথচালকও আছে, কিন্তু সে আমার অনুগত নয়। এমতাবস্থায় আমার জন্য ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি আছে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি আযান শুনতে পাও? ইবনু উম্মে মাকতূম বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তোমার জন্য অনুমতির কোন সুযোগ দেখছি না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৩
যখন এক জন অন্ধ ব্যক্তি ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি পাচ্ছে না তাহলে এক জন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি কীভাবে ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি পেতে পারে?! এতেই বুঝা গেলো, জামা‘আতে সালাত আদায় করা প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নিহায়েত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। তাই ওযর ছাড়া কারোর জন্য ঘরে সালাত পড়া কোনোভাবেই সঠিক নয়।
‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘উমর (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ জামা’আতে সালাতের ফযীলত একাকী আদায়কৃত সালাত অপেক্ষা সাতাশ গুণ বেশী।
সহিহ বুখারী : ৬৪৫
এই ফজিলত কেবল সওয়াবের সংখ্যাগত দিকেই নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি, গুনাহ মাফ, নেকির পরিমাণ বৃদ্ধি, ও জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রেও বিশাল গুরুত্ব রাখে।