গিবত কী?
গীবত শব্দটির আভিধানিক অর্থ দোষারোপ করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, পরচর্চা করা, পরনিন্দা করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষগুলো অন্যেও সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গীবত হারাম ও কবিরা গুনাহ।
গীবতের সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবীগণ বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মুসলিম ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা তার কাছে খারাপ লাগবে। জিজ্ঞেস করা হলো, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সে ত্রুটি বিদ্যমান থাকে, তুমি যে দোষ-ত্রুটির কথা বললে, তার মধ্যে সে দোষ-ত্রুটি থাকলেই তো তুমি গীবত করলে। আর যদি দোষ-ত্রুটি বর্তমান না থাকে, তবে তুমি ’’বুহতান’’ (মিথ্যারোপ) করলে। (মুসলিম)[1]
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, যদি তুমি তোমার ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে রয়েছে, তবে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার সম্পর্কে এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে নেই, তবে তুমি তার প্রতি ’’বুহতান’’ (মিথ্যা অপবাদ) দিলে।
[1] সহীহ : মুসলিম ৭০-(২৫৮৯), সহীহুল জামি‘ ৮৬, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৮৪৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৭৫৮, শু‘আবুল ঈমান ৬৭১৯, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ১১৫১৮, আস্ সুনানুল কুবরা ২১৬৯৫, সুনানুদ্ দারিমী ২৭১৪, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪৯৩, আহমাদ ৮৯৮৫, তিরমিযী ১৯৩৪, আবূ দাঊদ ৪৮৯৪, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৫৩৮।
ইয়াহইয়া ইবনু আইয়্যুব, কুতাইবাহ ও ইবনু হুজর (রহঃ) ….. আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জান, গীবত কী জিনিস? তারা বললেন, আল্লাহ ও তার রসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, (গীবাত হলো) তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাই এর মধ্যে বাস্তবিকই থেকে থাকে তবে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে যা বলছ তা যদি তার মধ্যে প্রকৃতই থেকে থাকে তাহলেই তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে।সহিহ মুসলিম ৬৪৮৭ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৫৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৪০৭)
আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন কেউ তার ভাইকে ‘কাফির’ বলে, তখন এ উক্তিটি তাদের একজনের ওপর বর্তায় (অর্থাৎ যে সত্যিকারের কাফির নয়, তার ওপর নয়; বরং বলনেও দায়ী হবে)।” বুখারী ও মুসলিম ৪৮১৫-
আয়িশাহ (রাঃ) বলেন:
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বললাম, ‘আপনার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট—সে (সাফিয়্যা) খাটো।’
তখন নবী ﷺ বললেন,
‘তুমি এমন একটি কথা বলেছো, যদি তা সমুদ্রের পানিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা সমুদ্রের পানিকেও পরিবর্তন করে ফেলবে।’সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৭৫
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক সন্দান্বেষণ হতে দূরে থাকো। নিশ্চয় কিছু কিছু সন্দেহ পাপ। তোমরা পরস্পরের গুপ্তচরী করো না।
তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে? – তোমরা তো তা ঘৃণা করো।
আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের তওবা কবুলকারী ও দয়ালু। সূরা হুজুরাত, আয়াত (৪৯:১২)
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
ধ্বংস তার জন্য, যে পশ্চাতে দোষারোপ করে ও সম্মুখে উপহাস করে। সূরা আল-হুমাযাহ (১০৪:১
সুতরাং মানুষের মধ্যে যে দোষ আছে এবং যার চর্চা সে অপছন্দ করে তা আলোচনা করাই গীবত। চাই সে দোষ তার শরীর সংক্রান্ত হোক কিংবা দীন ও চরিত্র বিষয়ক হোক কিংবা আকার-আকৃতি বিষয়ক হোক। গীবত করার আঙ্গিক বা ধরণও নানা রকম রয়েছে। যেমন, ব্যক্তির দোষ আলোচনা করা, বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে তার কর্মকাণ্ড তুলে ধরা ইত্যাদি।
গিবতের ভয়াবহ পরিণাম
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মি’রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরীল ! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো (গীবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো । সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৭৮
আল-মুসতাওরিদ (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের গীবত করে এক লোকমা ভক্ষন করবে আল্লাহ তাকে এজন্য জাহান্নাম হতে সমপরিমাণ ভক্ষন করাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের দোষত্রুটি বর্ণনার পোশাক পরবে আল্লাহ তাকে অনুরূপ জাহন্নামের পোশাক পরাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির (কুৎসা) রটিয়ে খ্যাতি ও প্রদর্শনীর স্তরে পৌছবে, মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাকে ঐ খ্যাতি ও প্রদর্শনীর জায়গাতেই (জাহান্নামে) স্থান দিবেন। সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৮১
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে বিরত থাকো, নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ।
গুপ্তচরবৃত্তি করো না, এবং তোমাদের কেউ যেন অন্য কারো গীবত না করে।
তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে সে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাবে? নিশ্চয়ই তোমরা তো তা ঘৃণা করো!
সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। সূরা হুজুরাত (৪৯:১২)
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
যখন তোমরা তোমাদের জিহ্বা দিয়ে তা (অপবাদ) প্রচার করতে থাকো, এবং তোমরা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কিছু বলো যার কোনো জ্ঞান তোমাদের নেই। আর তোমরা এটাকে তুচ্ছ মনে করো, অথচ এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে মহা গুরুতর।”
আর তোমরা এটাকে তুচ্ছ মনে করো, অথচ এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে মহা গুরুতর।” সূরা আন-নূর (২৪:১৫)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই এ দুজন কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো গুনাহের কারণে কবরে তাদের আজাব দেওয়া হচ্ছে না। এই কবরবাসী প্রস্রাব করার সময় সতর্ক থাকত না। আর ওই কবরবাসী গিবত করে বেড়াত। এরপর তিনি খেজুরের একটি কাঁচা ডাল আনিয়ে সেটি দুই টুকরা করে এক টুকরা এক কবরের ওপর এবং এক টুকরা অন্য কবরের ওপর গেড়ে দিলেন। তারপর বলেন, এ ডালের টুকরা দুটি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাদের শাস্তি কমিয়ে দেবেন। (বুখারি, হাদিস : ৬০৫২) (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫১৩)
গীবতের মাধ্যমসমূহ
১. জিহ্বার মাধ্যমে গীবত :
জিহ্বার হিফাযাত বলতে অশ্লীল-অবাঞ্ছিত কথা-বার্তা ইত্যাদি থেকে জিহ্বাকে রক্ষা করা। গীবত বলা হয় তোমার মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যমান কোন দোষ তার অসাক্ষাতে আলোচনা করা যা সে শুনলে তা অপছন্দ করবে। তার মধ্যে যদি দোষটি না থাকে তবে সেটা হবে বুহতান বা অপবাদ।
আরবীতে اَلشَّتَمُ বলা হয় গালি প্রদান করা, অভিসম্পাত করা। এতে জীবিত-মৃত, উপস্থিত-অনুপস্থিত সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবীগণ বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মুসলিম ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা তার কাছে খারাপ লাগবে। জিজ্ঞেস করা হলো, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সে ত্রুটি বিদ্যমান থাকে, তুমি যে দোষ-ত্রুটির কথা বললে, তার মধ্যে সে দোষ-ত্রুটি থাকলেই তো তুমি গীবত করলে। আর যদি দোষ-ত্রুটি বর্তমান না থাকে, তবে তুমি ’’বুহতান’’ (মিথ্যারোপ) করলে। (মুসলিম)[1]
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, যদি তুমি তোমার ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে রয়েছে, তবে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার সম্পর্কে এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে নেই, তবে তুমি তার প্রতি ’’বুহতান’’ (মিথ্যা অপবাদ) দিলে। মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৮২৮
[1] সহীহ : মুসলিম ৭০-(২৫৮৯), সহীহুল জামি‘ ৮৬, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৮৪৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৭৫৮, শু‘আবুল ঈমান ৬৭১৯, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ১১৫১৮, আস্ সুনানুল কুবরা ২১৬৯৫, সুনানুদ্ দারিমী ২৭১৪, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪৯৩, আহমাদ ৮৯৮৫, তিরমিযী ১৯৩৪, আবূ দাঊদ ৪৮৯৪, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৫৩৮।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করা হলো, গীবত কী? তিনি বললেন, তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে তোমার এমন কিছু বলা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বর্তমান থাকে? তিনি বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই তুমি তার গীবত করলে। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিলে। সুনান আবূ দাউদ ৪৮৭৪
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“মানুষ মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণ করার জন্য একজন তৎপর প্রহরী (ফেরেশতা) সদা প্রস্তুত থাকে।” সূরা কওফ (৫০:১৮)
২. অন্তরের গীবত :
অন্যের সম্পর্কে খারাপ কথা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের সম্পর্কে খারাপ চিন্তা করাও নিষিদ্ধ। অন্যের দোষত্রুটি অপরের নিকট বর্ণনা করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি তাদের দোষত্রুটি নিয়ে কল্পনা করাও নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে বিরত থাকো, নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ।
গুপ্তচরবৃত্তি করো না, এবং তোমাদের কেউ যেন অন্য কারো গীবত না করে।
তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে সে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাবে? নিশ্চয়ই তোমরা তো তা ঘৃণা করো!
সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। সূরা হুজুরাত (৪৯:১২)
মহান আল্লাহ একমাত্র গায়েব জানেন এবং মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের খবর রাখেন। আর ইবলীসের কাজ হচ্ছে বান্দাকে ধোকা দিয়ে তার মনের মধ্যে মন্দ ধারণা প্রোথিত করা। আর বান্দা যদি কারো প্রতি খারাপ ধারণা করে ফেলে, তাহ’লে ইবলীসকে সত্যায়ন করা হয়ে যায়। আর ইবলীসকে সত্যায়ন করা হারাম। ফলে কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করাও হারাম। কারণ কুধারণার মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি বা গোয়েন্দাগিরি করার মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা আরেক ধরনের কাবীরা গুনাহ। তাই আল্লাহ অত্র আয়াতে কুধারণার মাধ্যমে অন্তরের গীবত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ছিদ্রান্বেষণ করতে নিষেধ করেছে। তারপর বিশেষভাবে গীবত না করার আদেশ প্রদান করেছেন
ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পরস্পরকে হিংসা করবে না, একে অপরের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে না, সুপ্তদোষ সন্ধান করবে না, গুপ্ত ভুল-ভ্রান্তি অনুসন্ধান করো না এবং পরস্পরকে ধোকায় ফেলবে না। আর তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভ্রাতৃ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকো।সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর:৬৪৩২ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩০৬, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৫৫)
৩. ইশারা-ইঙ্গিতের গীবত :
কখনো কখনো চোখ, হাত ও মাথার ইশারার মাধ্যমেও গীবত হয়ে থাকে। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে বললাম, সাফিয়্যাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে আপনার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে এরূপ অর্থাৎ তিনি খাটো। তিনি বললেনঃ তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যা সমুদ্রে মিশিয়ে দিলে তাতে সমুদ্রের রং পাল্টে যাবে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নকল করলাম। তিনি বললেন, আমাকে এতো এতো সম্পদ দেয়া হলেও আমি কারো অনুকরণ পছন্দ করবো না। সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৭৫
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘আয়েশা (রাঃ) গীবত করার উদ্দেশ্যে ছাফিয়্যা (রাঃ)-এর দোষ বর্ণনা করেননি; বরং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তার ব্যাপারে খবর দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তথাপি সেটা গীবতের পর্যায়ভুক্ত ছিল’। সুতরাং গীবতের প্রকাশ হচ্ছে সেই দোষ বর্ণনা দেওয়ার মতোই। সংকেত, অঙ্গভঙ্গি, চোখ টেপা, ইশারা-ইঙ্গিত এবং অপরকে হেয় করা বুঝায় এমন প্রত্যেক কিছুই গীবতের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে গীবতকে সমর্থন দেওয়াও গীবত। কেননা গীবত শ্রবণকারীও গীবতের দায় এড়াতে পারবে না, যদি না সে অন্তর দিয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করে এবং মুখের ভাষায় সেটার প্রতিবাদ করে।
গীবত থেকে বিরত থাকা :
সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার দু’চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহ্বা) এবং দু’রানের মাঝখানের বস্তু (লজ্জাস্থান) এর জামানত আমাকে দিবে, আমি তার জান্নাতের যিম্মাদার। সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৭৪ (আধুনিক প্রকাশনী- ৬০২৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৩০)
এজন্য গিবত থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। যে ব্যক্তি গিবত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, সে বিশেষ কিছু উপকার পাবে। এখানে গিবত থেকে বেঁচে থাকার কিছু উপকার তুলে ধরা হলো-
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে আল্লাহ্ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে ক্লেশ না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। সহীহ বুখারী,৬৪৭৫. [৫১৮৫] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬০২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৩১)
আবূ শুরাইহ্ আল খুযায়ী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার দু’কান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছে এবং আমার অন্তর তা হিফাযাত করে রেখেছে, মেহমানদারী তিন দিন, ভদ্রতার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করা হলো, ভদ্রতা কী? তিনি বললেন, একদিন ও এক রাত (বিশেষ মেহমানদারী)। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা নীরব থাকে। সহীহ বুখারী ৬৪৭৬.[৬০১৯] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬০২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৩২)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয় বান্দা কখনও আল্লাহর সন্তুষ্টির কোন কথা বলে অথচ সে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। কিন্তু এ কথার দ্বারা আল্লাহ্ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবার বান্দা কখনও আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা বলে ফেলে যার পরিণতি সম্পর্কে তার ধারণা নেই, অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। [৬৪৭৭; মুসলিম ৫৩/৬, হাঃ ২৯৮৮] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬০২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৩৪)
নিচে গিবতকারীর জন্য কিছু করণীয় তুলে ধরা হলো যেগুলো আমল করলে গিবতের ভয়াবহ পরিণাম থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
১) তাওবা-ইস্তেগফার করা
কারো গিবত করে ফেললে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করা। গুনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে ভর্ৎসনার মাধ্যমে সেই ইস্তেগফার করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন গুনাহ না হয় সেজন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। এটি হলো গিবতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রথম পদক্ষেপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘কিন্তু যারা তাওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, এরাই তারা যাদের তাওবা আমি কবুল করি, আমি অতিশয় তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা: ১৬০)
২) যদি সম্ভব হয় ক্ষমা চেয়ে নেওয়া
যার গিবত করেছেন যদি তার কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে তার কাছে গিয়ে তার হক নষ্ট করার কারণে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। তবে যদি এতে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে কিংবা আরও বেশি ভুল বুঝার আশঙ্কা থাকে তাহলে অনেক আলেমের মতে মাফ চাইতে না যাওয়াই উত্তম। কিন্তু যেকোনো উপায়ে মাফ চেয়ে নেওয়াই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত। কেননা গিবত করার মাধ্যমে বান্দার হক নষ্ট হয়। আর বান্দার হক নষ্ট করার কারণে কেয়ামতের ময়দানে আটকা পড়তে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন আজই মাফ চেয়ে নেয়, তার ভাইয়ের জন্য তার কাছ থেকে নেকি কর্তন করে নেওয়ার আগে। কেননা সেখানে (হাশরের ময়দানে) কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি নেকি না থাকে তবে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৬৫৩৪)
৩) ওই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা
হাদিসে এসেছে, কেউ যদি কোনো মুসলিম ভাইয়ের জন্য অগোচরে দোয়া করে তাহলে তার জন্য ফেরেশতারাও দোয়া করেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম তার ভাইয়ের জন্য তার পশ্চাতে দোয়া করে, তখন তার (মাথার কাছে নিযুক্ত) একজন ফেরেশতা তাঁকে লক্ষ্য করে বলে, তোমার জন্যও এমনই হোক’। (সহিহ মুসলিম: ২৭৩২) সুতরাং যার গিবত করেছেন তার জন্য যদি দোয়া করেন আল্লাহর ফেরেশতারা আপনার গুনাহ মাফের জন্যও আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। তাছাড়া এমন দোয়াকে গিবতের কাফফারা বলা হয়েছে হাদিসে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গিবতের কাফফারা হলো তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে বলবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।’ (বায়হাকি)। যদিও হাদিসটিকে জয়িফ বলেছেন আলেমরা, তবুও এই হাদিসের ওপর আমল করতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক নয়।
৪) মজলিস শেষ করে দোয়া পাঠ করা
যেই মজলিসে গিবত করা হয়েছে সেই মজলিস থেকে উঠার সময় বিশেষ দোয়া পাঠ করা। এতে করে হাদিস অনুযায়ী, মজলিসের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। দোয়াটি হলো— سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইক।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার কাছে তাওবা করছি।’ (তিরমিজি: ৩৪৩৩)
সুতরাং দোয়াটি পাঠ করার মাধ্যমে মজলিসের গুনাহ থেকে অনেকটা নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ।
৫) মজলিসে ওই ব্যক্তির প্রশংসা করা
মজলিসে যে ব্যক্তির গিবত করা হয়েছে তার কোনো প্রশংসা করা হলে সেটি গিবতের গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার কারণ হতে পারে। তাই ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম নববি (রহ)-এর মতো প্রসিদ্ধ আলেমদের পরামর্শ হলো—যেই মজলিসে গিবত করা হয়েছে ওই মজলিসেই একই ব্যক্তির গুণকীর্তন করা উচিত, যাতে গিবতের গুনাহের অনেকটা ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে,‘তুমি নামায প্রতিষ্ঠা কর দিনের দু’ প্রান্ত সময়ে আর কিছুটা রাত অতিবাহিত হওয়ার পর, পূণ্যরাজি অবশ্যই পাপরাশিকে দূর করে দেয়, এটা তাদের জন্য উপদেশ যারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা হুদ: ১১৪)। কাজেই কারো গিবত হয়ে থাকলে তার গুণগুলোর উল্লেখ করাও উত্তম।
৪. নিজের জবানের হেফাজত করা
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬০১৮ [৫১৮৫; মুসলিম ১/১৯, হাঃ ৪৭, আহমাদ ৭৬৩০] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৮৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৮০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কারো গিবত করে ফেললে উল্লেখিত আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন। আমিন।